জীবন যেন এক ঘড়ির কাঁটা। মুহূর্তে মুহূর্তে টিক টিক স্বরে দূরে সরে যায়, তবে ফের ফিরে আসে হারানো জায়গায়। তবে তার সাথে তাল মিলিয়ে, স্রোতের মতো করে সময় বদলে যায়।
সাথে বাদলের হাওয়া বদলায়, মাদলের তাল বদলায়, মেঘের রং বদলায়, ঢেউয়ের দিক বদলায়; কিন্তু ঘড়ির কাঁটা? সে তো সব ঘুরে ফিরে আয়। তেমনি ঘড়ির কাঁটা আরো একবার ফিরে এসেছে।
যদিও মাঝে ২৩টা বছর পাড় হয়ে গিয়েছে। তবে সময়ের বিবর্তন বাস্তবতা দেখাচ্ছে, সেই হারানো দিনের মুখোমুখি করে দিচ্ছে। বলছিলাম আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগের ইতিকথা।
সেদিনও ক্রিকেট মাঠ ছাপিয়ে রাজপথে চলে আসে, হাজার হাজার ভক্ত-সমর্থক রাস্তায় নেমে পড়ে। ব্যানার, ফেস্টুন হাতে, স্লোগানে স্লোগানে মিছিল, মানববন্ধন হলো রাজধানীসহ চট্টগ্রামে।
এক দফা এক দাবি তাদের কণ্ঠে, গণমাধ্যমও সাড়া দেয় তাদের পক্ষে। তেইশ বছর পূর্বের সেই ঘটনার কোনো মিল কি খুঁজে পান এই সময়ে? পেতেই পারেন, যদি গত কিছুদিনে মিরপুরে গিয়ে থাকেন।
সাথে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিপরীতে শিক্ষানগরী ময়মনসিংহে চোখ রাখেন। হ্যাঁ, ১৯৯৯ সালের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, মাহমুদউল্লাহকে বিশ্বকাপ দলে ভেড়াতে ভক্ত-সমর্থকরা মাঠে নেমেছে।
প্রশ্ন এখন করতেই পারেন, এখন না হয় মাহমুদউল্লাহ; সেদিন কে ছিল তবে? ভক্ত-সমর্থকেরা রাজপথে নেমেছিল কার জন্য?হতে পারে কাকতালীয়। তবে অবাক হলেও সত্য।
মাহমুদউল্লাহর বাদ পড়ায় যাকে ভাবা হচ্ছে খল চরিত্রে, সেদিনের প্রতিবাদ ছিল এই মিনহাজুল আবেদিন নান্নুকেই দলে ফেরাতে! হ্যাঁ, আজ যেই নান্নুর বিপক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন, তার ওপর আঙুল তুলছেন;
সেই নান্নুর পক্ষেই সেদিন আপনার পূর্বসূরীরা নেমেছিলেন রাজপথে, তার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হাতে হাত রেখে! এখন বুঝেছে তবে, কেন বলেছি সময় হারালেও ঘড়ির কাঁটা ফিরে আসে?
যার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন, ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন, সেই নান্নুই সেদিন পরিণত ছিলেন ভালোবাসার পাত্রে। যাকে আজ নির্মম বলছেন, নিষ্ঠুর বলছেন, সেই তিনিই ছিলেন সেদিন মনের গহীনে।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! যাহোক, মাহমুদউল্লাহ যদিও বাদ পড়েছেন ব্যর্থতার অজুহাতে, তবে নান্নুর গল্পটা সম্পূর্ণ বিপরীতে। পারফর্ম করেও তার জায়গা হচ্ছিল না দলে, এমনকি ১৯৯৯ বিশ্বকাপ দল ঘোষণার দিনেও সেঞ্চুরি হেসেছিল তার ব্যাটে!
ঘরোয়া ক্রিকেটে সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন নান্নু। প্রথম শ্রেণিতে ২৪ ম্যাচে ৫১.৭৮ গড়ে ১,৭০৯ রান তার দখলে। একটা ডাবল সেঞ্চুরিও আছে তার নামে। আছে আরো ৪টি সেঞ্চুরি ও ৯টি হাফ সেঞ্চুরি।
লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ৬৫ ইনিংসে একটা শতক আর বারোটি অর্ধশতকে ১,৫৬৭ রান আছে তার ঝুলিতে। তবে অনেক কিছুই তো দেখা যায় না পরিসংখ্যানে, রয়ে যায় আড়ালে।
যারা দেখেছেন, শুধু তারাই জানেন নান্নু কতটা স্টাইলিশ আর নিখুঁত ব্যাটসম্যান ছিলেন সেই সময়ে। তবুও কেন জানি, কোন এক অজানা কারণে দলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় আর সেরা ব্যাটসম্যান হয়েও বিশ্বকাপ দলে জায়গা হয়নি শুরুতে।
তবে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা আর আন্দোলনে একটা সময় বাধ্য হয়েই দলে নিতে হয় নান্নুকে। তবে প্রথম দুই ম্যাচের একাদশে সুযোগ হয়নি তার, অন্যদের ব্যর্থতায় তৃতীয় ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাট করতে নামলেন,
দল তখন ২৬ রানেই ৫ উইকেট হারিয়েছে। সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েই অপরাজিত ৬৮ রানে ম্যাচ জয়ী ইনিংস খেলেন নান্নু। পরের ম্যাচেও অর্ধশতক তুলে অপরাজিত থাকেন পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।
এত কিছুর পরেও মন গলেনি সেই সময়কার ম্যানেজমেন্টের। বয়স বেশির অজুহাতে জায়গা হয়নি দেশের হয়ে প্রথম টেস্টের দলে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় পাওয়া সুখস্মৃতির সেই ম্যাচটাই নান্নুর ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ হয়ে থাকে।
কখনো টেস্ট না খেলার স্বীকৃতি নিয়েই বিদায় বলেন ক্রিকেটকে। অথচ দেশের টেস্ট স্বীকৃতিতে বড় অবদান ছিল তার। আর তিনিই ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম সেরা আর জনপ্রিয় ক্রিকেটার।
মাহমুদউল্লাহর দল বিচ্ছেদে কিংবা নানা কারণে যারা হরহামেশাই অহরহ বলে থাকে, নান্নু কী করেছেন জাতীয় দলে? এই লেখায় খানিকটা উত্তর মিলতে পারে তাদের জন্যে।
আর নান্নুর পথটা যে মসৃণ ছিল না, তা তো বুঝেই গেছেন এতক্ষণে। অসংখ্য চোরাবালি আর স্রোতের বিপরীতে লড়াই করেই এই পর্যায়ে আসতে হয়েছে তাকে। রাগ-ক্ষোভ, কষ্ট, অভিমান তো ছিল তার মনেও,
তবুও তবে সব চাপা দিয়ে রেখেছেন দেশের জন্যে। তবে এই আর তেমন কি, নান্নুর বাবা তো জীবনই দিয়ে দিয়েছেন দেশের জন্য স্বাধীনতার যুদ্ধে।
তারপরেও কি প্রশ্ন করবেন, কি অর্জন আছে নান্নুর জীবনে? একটা ছক্কাও তো মারতে পারেননি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে!